বিশেষ প্রতিনিধি: পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মধ্যে দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব সেটি এখন বড় আকার ধারণ করেছে। দুপক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে।
অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগে ইতিমধ্যে ঢাকা ও কুমিল্লায় সমিতির অন্তত ১৭১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৪ জনকে চাকরিচ্যুত ও দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে আরইবি। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬ জন, যাদের মধ্যে ছয়জনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ঘটনায় আরইবি পরিচালক (প্রশাসন) মো. আরশাদ হোসেন খিলক্ষেত যে মামলা করেছেন সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে, সমিতির কিছু বিপথগামী কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে বিদ্যুৎ খাতকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছেন। গত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীদের মদদে বিদ্যুৎ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মামলা-হয়রানির ভয়ে সমিতির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে দাপ্তরিক কাজ বিঘ্ন হওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের গ্রিড বিপর্যয় এবং গ্রাহক ভোগান্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুপক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুপারিশ করতে নাগরিক কমিটি গঠন করেছে ক্যাব।
অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে রোববার (২০ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে সমিতির আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে শনিবার (১৯ অক্টোবর) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বৃহস্পতিবার ‘শাটডাউন’-এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি আরইবি সংস্কার দাবি করে তারা বলেন, সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সমন্বয়কসহ স্বাধীন কমিশন গঠন করা পল্লীবিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অস্থিতিশীলতার সৃষ্টির জন্য আরইবিকে দায়ী করে পল্লীবিদ্যুৎ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে মামলা প্রত্যাহার করে ২৪ জনের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া ও স্ট্যান্ড রিলিজ এবং সংযুক্ত দুজনকে পদায়ন করা; গ্রাহকের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য সমিতি ও বোর্ড সংস্কার করে একীভূত করে একটি প্রতিষ্ঠান করা এবং স্থায়ী পদের বিপরীতে চুক্তিভিত্তিকদের নিয়মিত করা।
পল্লীবিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক মো. সালাউদ্দীন বলেন, ‘আমরা ন্যায্য দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছিলাম। একপর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত এবং ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয় আরইবি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন পল্লীবিদ্যুতের কর্মীরা। বিচ্ছিন্ন এই ঘটনার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়। কিন্তু এরপরও পল্লীবিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা, চাকরিচ্যুত এবং গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে।
সালাউদ্দীন পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। তাকে চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে মামলাও দিয়েছে আরইবি।
পল্লীবিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্তমান সরকারের পক্ষে, এমনটি দাবি করে সালাউদ্দীন অভিযোগ করেন, আরইবির কিছু কর্মকর্তা এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নে নেমেছেন। এতে বিদ্যুৎ খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। আমরা স্থিতিশীল পরিবেশে কাজ করতে চাই।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল আরইবির চেয়ারম্যান, দুজন সদস্য এবং একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে গতকাল দফায় দফায় ফোন দেওয়া হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সরকারী মাহফুজ আলম বলেন, ‘ইতিমধ্যে তাদের (পল্লীবিদ্যুতের) কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোর বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে। যেকোনো দাবি জানানোর জন্য সরকারের দরজা সবসময় খোলা রয়েছে। আমরা যেটা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, সেটা মাঠে না গড়ানোই ভালো।’
আরইবির অধীনে ৮০টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। দেশের ৪ কোটি ৭২ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৬১ লাখ গ্রাহকই আরইবির অধীন।
আরইবি ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি একীভূতকরণ এবং অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়নসহ চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মচারীদের স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে প্রায় ১০ মাস ধরে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিনের বঞ্চিত পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগস্টের শেষ দিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করার পর বৃহস্পতিবার আরইবি কর্তৃপক্ষ সমিতির কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত এবং মামলার পর ৮০টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে ৬১টিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ৩৩ জেলার প্রায় দুই কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কারখানার মালিক বাড়তি অর্থ ব্যয় করে জেনারেটরের মাধ্যমে তাদের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
গত বুধবার পল্লীবিদ্যুতের ২০ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার আরও চারজনকে চাকরিচ্যুত ও দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওইদিন দুই দফায় রাষ্ট্রদ্রোহ ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে ঢাকার খিলক্ষেত থানায় পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির ১৫ কর্মীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে আরইবি। আর শুক্রবার কুমিল্লায় একটি সমিতির ১৫৬ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
আন্দোলনকারীরা জানান, সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের জন্য গত ১ আগস্ট ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয় আরইবি। ইতিপূর্বে ওই কমিটির চারটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে দফায় দফায় সভা হলেও সরকারের সংস্কার উদ্যোগে আরইবির প্রত্যক্ষ অসহযোগিতার কারণে কমিটি চূড়ান্ত সুপারিশ প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
তাদের অভিযোগ, আরইবির নিম্নমানের বৈদ্যুতিক মালামাল ক্রয়, ভঙ্গুর বিতরণ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে গ্রাহকরা মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা এর অবসান চান।
বিরোধ নিষ্পত্তিতে নাগরিক কমিটি গঠন : আরইবি এবং পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিতে গতকাল ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নাগরিক কমিটি গঠন করেছে। ক্যাবের ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অধ্যাপক বদরুল ইমাম, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোমি, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ চিহ্নিত করে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রকাশ করবে কমিটি।
ক্যাব জানায়, আরইবি ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মধ্যে বিরাজমান বিরোধের কারণে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে আছে। যেকোনো সময় দেশের বিপুলসংখ্যক বিদ্যুৎ-ভোক্তা এর থেকেও চরম বিপর্যস্ত অবস্থার শিকার হতে পারেন বলে জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বিবেচনায় ওই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ক্যাব একটি নাগরিক কমিটি গঠন করেছে। কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ চিহ্নিত করে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রকাশ করবে।
এ প্রসঙ্গে শামসুল আলম বলেন, আরইবি এবং সমিতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটা এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে। দিনশেষে গ্রাহককে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি করলে এই অবস্থার তৈরি হতো না। এখানে বিরোধ নিষ্পত্তিতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ক্যাবের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হয়েছে।
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের শঙ্কা : বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে আরইবিসহ ছয়টি বিতরণ সংস্থাকে সরবরাহ করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি পিজিসিবি। বিদ্যুতের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন কেন্দ্রকে উৎপাদনে নির্দেশ দেয় তারা। বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। কোনো কারণে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ অনেক কম বা বেশি হলে ফ্রিকুয়েন্সির স্বাভাবিক ঠিক থাকে না। তখন গ্রিড বিপর্যয় হয়ে সারা দেশ বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়তে পারে। বৃহস্পতিবার সমিতিগুলো বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় অনেকটা এমন বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে একবারে সবগুলো সমিতির সরবরাহ বন্ধ না করায় ভারসাম্য রাখতে দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দেয় পিজিসিবি।
জানতে চাইলে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুল মোনায়েম চৌধুরী বলেন, পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে আরইবি দেশের মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। তারা যদি সময় নিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে তাহলে সেটা সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু একসঙ্গে যদি হঠাৎ দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াট লোড কমিয়ে দেয় তখন ‘ফ্রিকুয়েন্সি’ নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। তিনি বলেন, তবে আশা করি তারা এটা করবে না।
ভুক্তভোগীদের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাগর-রুনি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা জানান, উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে রোববার (২০ অক্টোবর) যে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে সেখানে সমঝোতা হবে বলে তারা আশা করছেন। মূলত আরইবির স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে পল্লীবিদ্যুতের কর্মকর্তারা দাবি করেন।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও উন্নত গ্রাহক সেবার জন্য আরইবির সংস্কার দাবি করে বক্তারা বলেন, সরকারের কাছে আবেদন, প্রকৃত সত্য আড়াল করে কারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনুন। নিরীহ পল্লীবিদ্যুৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদ ও বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করুন। সূত্র : দেশ রূপান্ত
Leave a Reply