সময় সংবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশে সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিশু বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার সংস্পর্শে এসেছে, যার ফলে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ‘আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ’ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় এই উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালায় সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
কর্মশালায় জানানো হয়, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), ইউনিসেফ এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) সম্প্রতি যৌথভাবে একটি সমীক্ষা চালায়। এতে খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী, সিলেট ও ঢাকা জেলায় ১৪৮০ শিশুর রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
আয়োজকরা জানান, এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব শিশুর মধ্যে ঢাকায় ৮০ শতাংশ এবং অন্য চার জেলায় ৪০ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি। এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে স্থায়ী প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের ওপর।
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা জানান, সিসা দূষণ শিশুদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটি শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করতে পারে, ফলে দীর্ঘমেয়াদী শিখন সক্ষমতার সমস্যা, স্নায়ু তন্তু সংক্রান্ত রোগ এবং আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও সিসার ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে হৃদরোগ এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য এই দূষণ তাদের অনাগত শিশুর জন্য হুমকি হতে পারে।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সিসা ও ভারী ধাতুর দূষণ একটি নীরব ঘাতক, যা মোকাবিলায় প্রয়োজন জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। সবার জন্য একটি সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সব অংশীজনকে এই কর্মশালায় সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই। বাংলাদেশে বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে আসার প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করতে আমরা একত্রে একটি বিস্তৃত ও কার্যকরী কর্ম পরিকল্পনা গড়ে তুলতে পারবো।
বাংলাদেশে সিসা দূষণের ব্যাপকতা মোকাবিলায় ইউনিসেফ সহায়তায় সরকার এবং বেসরকারি খাতের অংশীদাররা একত্রে কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ারস। তিনি বলেন, সাধারণত ভারী ধাতু বিশেষ করে সিসা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ওপর বেশি গুরুতর প্রভাব ফেলে। এই ক্ষতি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সীমা কমে যায় এবং প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ (কার্ডিওভাসকুলার) দেখা দেয়, গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে তাদের অনাগত শিশুরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সুস্পষ্ট আইন এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতের সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপে এই দূষণ প্রতিরোধযোগ্য। এভাবে এই দূষণের ফলে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের যে অতিরিক্ত খরচ ও ভোগান্তি হয়ে থাকে, পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বাড়তি খরচ হয়ে থাকে, সেটাও অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের জুনে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যৌথভাবে ‘মাল্টি পলইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)’ শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়, যেখানে প্রথমবারের মতো সিসাসহ অন্যান্য বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি পরিমাপ করা হবে। এটি দেশের জাতীয় পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করবে এবং সিসা দূষণ রোধে নীতিমালা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া, বাংলাদেশের ‘পার্টনারশিপ ফর এ লেড-ফ্রি ফিউচার’ (পিএলএফ) উদ্যোগের মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো হয়েছে।
Leave a Reply