বিশেষ প্রতিবেদক: সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড- মিল্ক ভিটায়ও ‘শেখ’ পরিবারের ছায়া পড়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিস্ট লুটেরা সরকারের আমলে। শত শত কোটি টাকা লুট হয়েছে খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ নাদির হোসেন লিপুর নেতৃত্বে। ২০১৫ সালে লিপু অনেকটা জোর করেই মিল্কভিটার চেয়ারম্যান পদ দখল করেন। সেই থেকে গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতন পর্যন্ত জোরপূর্বক পদে বহাল থেকে লাগামহীন লুটপাট চালিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। কোনো বিধি-বিধান, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। শেখ নাদির হোসেন লিপুর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের লুটপাটের কারণে সরকারি এই লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন রসাতলে গিয়ে পৌঁছেছিল।
অবাক ব্যাপার হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যাদের হাতে প্রতিষ্ঠানটিকে টেনে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেই এডহক কমিটিই নতুন করে আওয়ামী স্টাইলে লুটপাট শুরু করেছে। এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খোদ পরিচালনা (এডহক) কমিটির চেয়ারম্যান কমান্ডার (অব.) জহিরুল ইসলাম নিজেই। তাঁর সঙ্গে প্রধান সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছেন মিল্কভিটার সমিতি বিভাগের ম্যানেজার ডা. মো আক্তার হোসেন নোবেল, যিনি অনেকটা জোরপূর্বক অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি পদ দখল করে আছেন। এই চক্রে আরো রয়েছেন পরিচালক জেড খান মজলিস, জুনিয়র অফিসার (বিপনন) আবদুর রউফ লাভলু প্রমুখ। সিন্ডিকেটটির লুটপাটের মাত্রা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লুটপাটকেও হার মানাচ্ছে।
এডহক কমিটি গঠিত হয়েছে ১২০ দিনের জন্য। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ এই কমিটি নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠানটিকে টেনে তোলার কাজে কোনো রকমের সাফল্য দেখাতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টার পরিবর্তে বরং দেখা গেছে নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায় মেতে ছিলেন তারা। তারপরও একই কমিটিকে গত ৪ এপ্রিল থেকে আবারো ১২০ দিনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। সময় যেহেতু সীমিত তাই কমিটির চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা এই দফায় আরো বেশি মাত্রায় দুর্নীতি-অনিয়মে মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদের নতুন মাত্রার লুটপাটের কারণে মিল্কভিটা আগের বছরের তুলনায় এ বছর ৮ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। টেন্ডার বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা এরা করছেন না। দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণের নামে শ্রমিকপ্রতি অগ্রিম তিন থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হচ্ছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটিতে এ ধরনের দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৮৫০ জন। মিল্কভিটায় বর্তমানে কর্মরত ১৬ জন কর্মকর্তাকে উচ্চতর গ্রেডে পদোন্নতির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদের কাছ থেকেও প্রায় কোটি টাকা অগ্রিম ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। মিল্কভিটায় এমন অনেক নতুন পরিবেশক নিয়োগ করা হচ্ছে যাদের সুনির্দিষ্ট যথাযথ ঠিকানাও নেই। এসব নতুন পরিবেশকের প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা করে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মচারী বদলি বাণিজ্যও চলছে এখন ব্যাপকহারে। এসব বদলিতে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারদের কাছ থেকে টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে কমিশন আদায়ও করা হচ্ছে। টেন্ডার কারসাজি করে প্রকৃত সরবরাহকারীদের পরিবর্তে কাজ দেয়া হচ্ছে নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের। ব্যাপকহারে ভেজাল দুধ তৈরির বাণিজ্যও শুরু হয়েছে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে, যা অতীতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আমলে এতটা দেখা যায়নি। দুধের ফ্যাট ও পরিমাণে পানি মিশিয়ে এই চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান কমান্ডার (অব.) জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন এসব দুর্নীতি-অপকর্মে প্রধান সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছেন মিল্কভিটার বহুল আলোচিত ও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ-ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা ডা. মো আক্তার হোসেন নোবেল (যিনি নোবেল আক্তার নামে পরিচিত)। আওয়ামী লীগ আমলেও এই কর্মকর্তা শেখ নাদির হোসেন লিপুর দুর্নীতি-অপকর্মে সহযোগীর ভূমিকায় থেকে নিজে নানাভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি থেকে। ইতিপূর্বে যেসব কর্মস্থলে তিনি কাজ করেছেন প্রতিটিতেই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। দুর্নীতির টাকায় অর্জিত অর্থে রূপগঞ্জে বিপুল পরিমাণে জমি কিনেছেন বলে জানা গেছে। আক্তার হোসেন নোবেল মূলতঃ গরুর ডাক্তার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু তিনি খামারে গরুর চিকিৎসার কাজে না গিয়ে নিয়মিত প্রধান কার্যালয়ে বসে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দুর্নীতি-অপকর্মে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছেন। তিনি যাতে প্রধান কার্যালয়ে বসতে পারেন এজন্য পদায়ন নিয়েছেন এ কার্যালয়ের সমিতি বিভাগে। চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলামের প্রভাব খাটিয়ে তিনি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদটি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন, যদিও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট চিহ্নিত ও দুর্নীতি-লুটপাটে জড়িত থাকার কারণে তাঁর এখন পালিয়ে থাকা অথবা জেলে আটক থাকার কথা। এই আক্তার হোসেন সারা দেশে মিল্কভিটার বিভিন্ন কারখানায় চেয়ারম্যানের সফরসঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন প্রায়ই। এসব সফরের মাধ্যমে তিনি বদলি বাণিজ্যসহ নানা অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, আক্তার হোসেন নোবেল ইতিপূর্বে সাতক্ষীরা দুগ্ধ কারখানায় কর্মরত থাকাকালে বড় রকমের দুর্নীতি-অনিয়মে অভিযুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে তখন ফ্যাট, এসএনএফ ও কৃত্রিম তরল দুধ উৎপাদনে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে তদন্তও হয়। তদন্তে আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও আর্থিক ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতির তথ্য উদঘাটিত হয় এবং এজন্য তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয় তখন। শুধু সাময়িক বরখাস্তই নয়, তার বিরুদ্ধে আরো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যান নাদির হোসেন লিপুকে মোটা অংকের অর্থে ম্যানেজ করেন। এছাড়া তিনি টেকেরহাট খামারে পদায়নে থাকাকালেও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন। টেকেরহাট খামারে খড় ক্রয়সহ নানা রকমের অনিয়মের মাধ্যমে অন্ততঃ ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পর পর দুই দফায় মিল্কভিটার চেয়ারম্যানে পদে থেকে কমান্ডার (অব.) জহিরুল ইসলামের লোভ আরো অনেক বেড়ে গেছে। মোটা অংকের অর্থে মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে প্রতিষ্ঠানটির নতুন পরিচালনা কমিটি গঠনের নির্বাচন না দেয়ার পাঁয়তারা করছেন। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন পরিচালক জেড খান মজলিসও। এই কমিটিকে যখন গত ৫ ডিসেম্বর ১২০ দিনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাতে প্রধান শর্ত ছিল যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত পরিচালনা কমিটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু কমিটি তা করতে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বস থেকে টেনে তোলার কাজেও কমিটি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তারপরও একই কমিটিতে পুনরায় ১২০ দিনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়, যদিও সমবায় আইন অনুযায়ী এটা সম্পূর্ণ অবৈধ।
সূত্র : শীর্ষ নিউজ
Leave a Reply